ভূমি সংক্রান্ত সাধারণ কিছু তথ্য বা শব্দাবলি আমরা প্রায়ই ব্যবহার করি কিন্তু তার সঠিক ইতিহাস বা অর্থ অনেকের জানা নেই। আসুন জেনে নেই এমন কিছু শব্দের উৎপত্তি, ইতিহাস ও ব্যবহার।
২। ভূমি জরিপ:
জরিপ তথা ইংরেজী ঝঁৎাবু শব্দটি বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়ে থাকে। ভূমি জরিপ বলতে বিভিন্ন মৌজা তথা গ্রাম বা সীমানা ভিত্তিক নকশা তৈরি বা জমির মালিকানা সংক্রান্ত পুরাতন রেকর্ড পর্যালোচনা বা যাচাই বাছাইকে বুঝায়। অর্থাৎ সহজ ভাষায় জরিপের সময় পুরাতন তৈরীকৃত নকশা ও রেকর্ড সংশোধন করা এবং জমির আকৃতি ও প্রকৃতি পরিবর্তন হয়ে থাকলে বা মালিকানার পরিবর্তন হয়ে থাকলে সেই মোতাবেক সামঞ্জস্য রেখে মৌজা বা সীমানার মধ্যে জমির নকশা এবং কাগজ পত্রের রেকর্ড তৈরি করাকে বুঝায়। আইনের ভাষায় বলা যায়, জমিদারী অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০, সার্ভে এন্ড সেটেলমেন্ট (এস.এস.) ম্যানুয়াল-১৯৩৫, সার্ভে এক্ট ১৮৭৫, প্রজাস্বত্ব বিধিমালা ১৯৫৫, এবং অপরাপর জরিপ আইনের বিধান মতে মৌজা ভিত্তিক ভূমির রেকর্ড তথা খতিয়ান ও নকসা প্রস্তুতের কার্যক্রমকে ভূমি জরিপ বলা হয় ।
৩।নকশা:
নকশা হলো কোনো মৌজাভুক্ত ভূমির বাস্তব চিত্র বা ভূ-চিত্র।
৪।মৌজা:
মৌজা হলো জরিপের একটি ভৌগোলিক ইউনিট। একটি ইউনিয়নকে কয়েকটি মৌজায় বিভক্ত করে এ ভৌগলিক ইউনিট করা হয়।
৫। জেএল নম্বর:
উপজেলার অন্তর্গত মৌজা সমূহের পরিচিতমূলক ক্রমিক নম্বরকে জেএল নম্বর বা জুরিসডিকশন লিস্ট নম্বর বলে । মৌজার উত্তর পশ্চিম কোণ থেকে শুরু করে পূর্ব-দক্ষিণ কোণে গিয়ে এ নম্বর দেয়া শেষ করা হয়।
৬।খতিয়ান:
খতিয়ান হলো দখল স্বত্বের প্রামাণ্য দলিল। এক বা একাধিক দাগের সম্পূর্ণ বা আংশিক ভূমি নিয়ে এক বা একাধিক ব্যক্তির নামে সরকার বা রাজস্ব অফিসার কর্তৃক যে ভূমি স্বত্ব প্রস্তুত করা হয় তাকে খতিয়ান বলে। প্রতি খতিয়ানের একটি পৃথক পরিচিতি নম্বর থাকে। খতিয়ানকে “রেকর্ড অব রাইটস” বা “স্বত্বলিপি” বলা হয়। খতিয়ান হচ্ছে নিখুঁত মালিকানা স্বত্ব ও দখলী স্বত্বের প্রমাণ্য দলিল। খতিয়ানে তৌজী নম্বর, জেএল নম্বর, স্বত্বের বিবরণ, মালিকের নাম, পিতার নাম, ঠিকানা থাকে। খতিয়ানের অপর পৃষ্ঠায় দাগ নম্বর, প্রত্যেক দাগের উত্তর সীমা (উত্তর দাগ), ভূমির শ্রেণী দখলকারের নাম, ভূমির পরিমাণ, হিস্যা, হিস্যা মতে পরিমাণ লেখা থাকে। উপযুক্ত আদালত বা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ভুল প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত খতিয়ান নির্ভূল হিসাবে গণ্য হতে থাকে।
৭। দাগ নম্বর:
একটি মৌজার বিভিন্ন মালিকের বা একই মালিকের বিভিন্ন শ্রেণীভুক্ত ভূমিকে নকশায় যে পৃথক পরিচিতি নম্বর দ্বারা চিহ্নিত করা হয় তাকে বলে দাগ নম্বর।
৮। বাটা দাগ:
নকশায় ভুল বসত কোনো প্লট এর দাগ নম্বর বাদ পড়লে, শেষ প্লট নম্বরটির পরের নম্বরটি নিচে লিখে এবং বাদ পড়া প্লটের নম্বরটি উপরে লিখে (ভগ্নাংশের ন্যায়) প্রাপ্ত যে নম্বর পাওয়া যায় তা দিয়ে বাদ পড়া প্লটটি চিহ্নিত করা হয় তাকে বাটা দাগ বলে।
৯। ছুট দাগ:
নকশায় দাগ নম্বর বসানোর সময় ভুল বসতঃ কোনো একটি অংক/সংখ্যা বাদ পড়লে অর্থাৎ ছুটে গেলে তাকে ছুট দাগ বলে। যেমন ১, ২, ৩ বসানোর পর ৫ ও ৬ বসিয়ে ফেলা এখানে ৪ ছুট দাগ। অর্থাত ঐ নকশায় ৪ নম্বর নামে কোন প্লটের অস্তিত্ব নেই।
১০। পর্চা:
জরিপ চলাকালীন সময়ে বুজারত স্তরে ভূমি মালিককে প্রস্তুতকৃত খসড়া খতিয়ানের যে অনুলিপি দেয়া হয় তাকে পর্চা বলে। পর্চা জরিপ কর্মচারী কর্তৃক অনুস্বাক্ষরিত হওয়া উচিত।
১১। হাল্ডিং:
একটি খতিয়ানে একটি দাগ থাকতে পারে আবার একাধিক দাগও থাকতে পারে। এরূপ একটি খতিয়ানের অন্তর্ভূক্ত ভূমিকে হোল্ডিং বা জোত-জমা বলে। হোল্ডিং এর পরিচিত নম্বরকে হোল্ডিং নম্বর বলে।
১২। দাখিলা:
ভূমি উন্নয়ন কর আদায়ের বিপরীতে প্রদত্ত রসিদকে বলে দাখিলা বা আরআর (রেন্ট রিসীট) দাখিলা ভূমি মালিকানা প্রমাণের প্রাথমিক দলিল।
১৩। ডিসিআর:
ভূমি উন্নয়ন কর ব্যতিত অন্যান্য সরকারী পাওনা আদায়ের জন্য যে রসিদ দেয়া হয় তাকে ডিসিআর (ডুপিকেট কার্বন রিসীট) বলে।
১৪। ফিল্ড বুক:
জরিপের প্রয়োজনে কিস্তোয়ার কালে অফসেট গ্রহণসহ চলমান চেইনের রিডিং লিখনের জন্য যে বই ব্যবহৃত হয় তাকে ফিল্ড বুক বলে। এটি দেখে পরবর্তীতে টেবিলে পি-৭০ সীটে স্বহস্তে নকশা অংকন করা হয়।
১৫। জরিপকালে ব্যবহৃত কালি/ (রং) এর বিবরণ:
ক) খানাপুরী স্তরে ব্যবহার করতে হবে কালো কালি
খ) বুজারত স্তরে ব্যবহার করতে হবে সবুজ কালি
গ) তসদিক স্তরে ব্যবহার করতে হবে লাল কালি
ঘ) আপত্তি স্তরে ব্যবহার করতে হবে বু-কোবাল্ট কালি
ঙ) আপিল স্তরে ব্যবহার করতে হবে কালো কালি
১৬। পেরীফেরী:
হাট বাজারের আয়তন প্রতিয়নত সম্প্রসারিত হয়ে থাকে। এরূপ সম্প্রসারিত অংশকে বাজারের অন্তর্ভূক্ত করা, হাট-বাজারের তোহামহাল, চান্দিনা ভিটি ও বন্দোবস্তযোগ্য খাসজমি চিহ্নিত করার লক্ষ্যে সার্ভেয়ার দ্বারা সরজমিনে পরিমাপপূর্বক হাট-বাজারের নক্সা তৈরীসহ চর্তুসীমা নির্ধারণ করাকে বলে পেরীফেরী।
১৭। নালজমি:
আবাদযোগ্য সমতল জমিকে নাল জমি বলে।
১৮। তৌজি:
১৭৯৩ সালে প্রবর্তীত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তীয় ভূমির জন্য কালেক্টরীতে যে রেজিস্ট্রি বই থাকতো তাকে তৌজি বলে। প্রত্যেকটি তৌজিরই ক্রমিক নম্বর থাকে। জমিদারের অধীনে প্রজার জোতকেও তৌজি বলা হতো।
১৯। কটকবলা:
সুদের পরিবর্তে মহাজনের দখলে জমি দিয়ে ঋণ নিয়ে যে দলিল দেয়া হয় তাকে কটকবলা বলে। খাতক যতদিন টাকা পরিশোধ করবে না ততদিন মহাজন এ জমি ভোগ দখল করতে থাকে।
২০। চান্দিনা:
বাজারের ভিটি ভূমিকে চান্দিনা বলা হয়। এটি মূলত দোকানদারের হোল্ডিং।
২১। জমা বন্ধী:
খাজনার তালিকাকে জমা বন্ধী বলে।
২২। চালা ভূমি:
নালের চেয়ে উঁচু আবাদী ভূমি, পুকুরের পাড় ইত্যাদি রকম ভূমিকে বলে চালা।
২৩। হালট:
জমিজমার মধ্যবর্তী চওড়া আইল বা পথ যার উপর দিয়ে চাষী হাল বলদ নিয়ে চলাফেরা করে। হালটকে গোপাটও বলা হয়।
২৪। চর্চা জরিপ:
চর্চা অর্থ চর পয়স্থি জমি বা চরের জরিপকে বলে চর্চা জরিপ। এই জরিপ করে যে নকশা তৈরি করা হয় তাকে চর্চা নকশা বলে।
২৫। তফসিল:
কোনা জমি যে মৌজায় অবস্থিত সে মৌজার নাম, জেএল নম্বর, খতিয়ান নম্বর, দাগ নম্বর, জমির শ্রেণী, পরিমাণ, জমির চৌহদ্দি বর্ণনা ইত্যাদি পরিচিতি সম্বলিত বিবরণকে ঐ জমির তফসিল বলে।
২৬। বাইদ:
নীচু কৃষি জমিকে বাইদ বলে।
২৭। নয়ন জুলি:
বাঁধ সংলগ্ন নীচু জলা ভূমিকে বলে নয়ন জুলি।
Source: SOB, BRAC